Thursday, April 7, 2016
চাকরি প্রার্থীর লাইভ ইন্টারভিউ
শাকিল : আসতে পারি স্যার?
সিইও : আসুন, বসুন, হোটেলে আসতে বলায় ভয় পেয়েছেন? শাকিল : না স্যার। বরং স্ট্রেস রিলিফের জন্য জায়গাটা ভালোই। সিইও : গ্রেট, সিভি তো ভালোই লিখছেন, মাত্র দুই পেজ কেন? শাকিল : স্যার, আমি দৈনিক যুগান্তরের একটা লেখা পড়ে জেনেছি, ১০ বছর চাকরি করা পর্যন্ত সিভি দুই পেজ থাকা ভালো। সিইও : বাহ, আপনি পড়াশোনাও করেন। আপনি তো ভাই কোম্পানিতে ঢোকার আগেই আমার ভালো চান না (মজা করতে করতে)। সিভি বড় করে লিখবেন, যাতে আমরা সের দরে বেচলে ভালো দাম পাই। বুঝলেন? ইন্টারভিউ দিতে যে দিতে এসেছেন, অফিসে জানে?
শাকিল : জী না স্যার, জানে না। সিইও : আমি তাইলে ফোন দেই? ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন অফিস ফাঁকি দিয়ে। বলে দেই? শাকিল : আজকে ফোন দিয়েন না, স্যার, কাল ফোন দিয়েন। আজকে আমার স্যার ঢাকার বাইরে। (লক্ষ্য করুন, কিভাবে একটি ট্রিকি প্রশ্ন শাকিল সাহেব সামলালেন) এরপর ধীরে ধীরে সিইও স্যার মেইন প্রশ্নগুলো করলেন, প্রশ্নগুলো আপনাদের জানাচ্ছি। উত্তর ক্যান্ডিডেট সঠিক ভাবেই দিয়েছিলেন।
১। সেলস ও মার্কেটিংয়ের মধ্যে কি কোনো পার্থক্য আছে? কি মনে হয়? ২। আমাকে এই কলমটি বিক্রি করে দেখাও। ৩। এফএমসিজি থেকে হেবি মেশিনারিজ, সেক্টর চেঞ্জ, আপনি এটা কিভাবে খাপ খাওয়াবেন? ৪।
কিভাবে মার্কেট রিসার্স করতে হয়? ৫। আপনার ইন্ডাস্ট্রিতে মার্কেট প্লেয়ার কারা কারা? তাদের শেয়ার কেমন? ৬। কিভাবে ডিস্ট্রিবিউটর তৈরি করতে হয়? জানা আছে? ৭। সাপ্লাই চেইন সেলসের সঙ্গে কিভাবে জড়িত? ৮। অপারেশন ডিপার্টমেন্টের কাজ কিভাবে সেলসের সঙ্গে জড়িত? ৯।
আমার কোম্পানির প্রোডাক্ট বাজারজাত করতে গেলে আমার কি কি করা উচিত বল তো? ১০। আমাকে একটা ঝডঙঞ এনালাইসিস করে দেখান তো এই ইন্ডাস্ট্রির। ১১। আপনার আগামী ৯০ দিনের কর্ম পরিকল্পনা কি? এগুলো সেক্টরভিত্তিক প্রশ্ন, তাই এগুলোর উত্তর আর লিখছি না।
আপনাদের ক্ষেত্রেও এরকম সেক্টরভিত্তিক প্রশ্ন করা হবে, যারা যে পোস্টের জন্য আবেদন করেছেন তাদের সেরকম প্রশ্ন করা হবে। টেকনিক্যাল পোস্টের জন্য টেকনিক্যাল প্রশ্ন, অ্যাকাউন্টসের জন্য ওই রিলেটেড। এরপর সিইও স্যার আবার ফেরত আসলেন ট্রিকি প্রশ্নে। সিইও : আপনার কাছে কে বেশি আপন, কোম্পানি নাকি ডিস্ট্রিবিউটর? শাকিল : অবশ্যই কোম্পানি, কারণ, কোম্পানিই আমাকে বেতন দেয়। কাজেই কোম্পানিই আমার বেশি আপন। (শাকিল শাহেব বোঝালেন তিনি কোম্পানির প্রতি নিবেদিত একজন কর্মী।) সিইও : রাত ১২টায় আপনাকে ফোন করে ডাকা হল, আপনি কি যাবেন? শাকিল : আমি যদি ফোনে সমস্যা মিটিয়ে ফেলতে পারি তাহলে যাব না, আর যদি তা না পারি, তাহলে যাব। সিইও : কেন যাবেন? রাত ১২টা তো ঘুমানোর সময়। শাকিল : কারণ সমস্যাটা আমার। আমার প্রোডাক্ট, আমার সার্ভিস, আমার এরিয়া, আমার কাজ। কাজেই সেটা আমাকেই মিটাতে হবে। আমি তো সেই দায়িত্ব এড়াতে পারি না। (লক্ষ্য করুন, শাকিল সাহেব বুঝাচ্ছেন উনি পরিশ্রমী এবং একজন নিবেদিত কর্মী) সিইও : ধরুন, সমস্যাটা আপনার না, আরেকজনের। তাহলে কি যাবেন? (লক্ষ্য করুন, সিইও স্যার এবার আরও পেচাচ্ছেন শাকিল সাহেবের উত্তরের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য)।
শাকিল : দরকার হলে যাব, কারণ, আমি আরেকজনের সমস্যায় সাহায্য করলে তিনিও একদিন আমার সমস্যায় সাহায্য করতে আসবেন। (শাকিল সাহেব আবারও সাবলীল ভাবে উত্তর করে বেরিয়ে গেলেন ফাঁদ থেকে। তাছাড়াও উনি বোঝালেন যে উনি সবার সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে পছন্দ করেন) সিইও : আপনার মতে ডিসিশন কি কোম্পানির ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে নিচে যাওয়া ভালো, নাকি নিচে থেকে উপরের দিকে আসা ভালো? শাকিল : ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে নিচে আসা ভালো। বটম লেভেলের সবার চাহিদা টপ লেভেল নাও পুরা করতে পারে। কিন্তু টপ লেভেলের মেসেজ বটম লেভেলে সঠিকভাবে পৌঁছালে হাঙ্গামা কম হয়। সিইও স্যার আবার সিভিটি দেখলেন। শাকিল সাহেবের সিভিতে কিছু ট্রেনিং উল্লেখ আছে। সিইও : বাহ, আপনি তো দেখি বেশ কিছু ট্রেনিংও করেছেন। ট্রেনিং করা তো বিপজ্জনক। (মজা করে বললেন) কার কার ট্রেনিং করেছেন, দেখি, সেলসের ট্রেনিং করেছেন রাজিব আহমেদের। উনাকে চিনেন? শাকিল : জি স্যার, উনার বই আমি পড়েছি, উনার ট্রেনিংও আমি করেছি। সিইও : এ তো পড়াশোনা করবেন না, আমরা চাই অনুগত লোক। যা বলব, তাই করবেন। ঠিক কি না? বাই দ্যা ওয়ে, আপনার রাজিব স্যার কিন্তু আমার বন্ধু। (স্যার মজা করতে করতে বললেন) শাকিল : জি স্যার, আমি পড়াশোনা করে যা যা জানব, সেটাও আমি তো কোম্পানির কাজেই লাগাব। সিইও : আচ্ছা, আপনাকে পছন্দ হচ্ছে না আমার। আপনি কি আমাকে বলতে পারবেন আপনাকেই কেন নিব? ওই যে আরও লোকজন আসছে, উনাদেরকেও তো নিতে পারি, তাই না? (স্যার একটা মানসিক আঘাত দিয়ে প্রশ্নটা করলেন) শাকিল : আমি স্যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কেটিয়ের ওপর বিবিএ, এমবিএ করেছি যা এই পোস্টের জন্য চাওয়া হয়েছিল। আগের কোম্পানিতে আমার অ্যাচিভমেন্ট ছিল ১০৭ শতাংশ।
ইন্ডাস্ট্রি চেঞ্জ হলেও সেলসের বেসিক জিনিসগুলো একই থাকবে। নতুন কিছু লোকের সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। আমি বেশ ভালো লোকজনের সঙ্গে মিশতে পারি, কাজেই এটাও আমি খুব তাড়াতাড়ি রপ্ত করে নিতে পারব। আমি এক্সেল, পাওয়ার পয়েন্টের যেসব কাজ জানি তাও এই পোস্টের জন্য দরকারি। তাই, সব মিলিয়ে আমি নিজেকে এই পোস্টের জন্য যোগ্য ক্যান্ডিডেট বলেই মনে করি। (শাকিল সাহেব নার্ভাস না হয়ে সাবলীল ভাবে এই প্রশ্নটিরও উত্তর দিলেন) সিইও : চাকরি কেন ছাড়তে চান? আগের কোম্পানি কি খারাপ? (মনে রাখবেন, আগের কোম্পানি বা আগের বসের নামে নেগেটিভ কথা কেউ পছন্দ করেন না। আপনি আগের কোম্পানি সম্পর্কে নেগেটিভ কিছু বলা মানে হল, এই কোম্পানি সম্পর্কেও নেগেটিভ কথাই বলবেন। শাকিল সাহেবের মনোভাব জানার জন্যই এই প্রশ্নটি করা হয়েছে। শাকিল : আমি তো বলিনি আমার কোম্পানি খারাপ, তাই চাকরি ছাড়ব। সিইও : তাহলে ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন কেন? শাকিল : স্যার, আপনার কোম্পানি নিঃসন্দেহে দেশের অন্যতম শীর্ষ কোম্পানি। সবাই বেটার স্কোপ খোঁজে। আমিও তাই এসেছি। যদি সব দিক ম্যাচ করে তাহলে আমি আমার কোম্পানির কাজ বুঝিয়ে দিয়ে যথাযথ নিয়ম মেনেই রিজাইন দিব। সিইও : কয়দিন থাকবেন আমাদের কোম্পানিতে? আবার দুই দিন পর চলে যাবেন না তো? শাকিল : যতদিন আমার কাজ দ্বারা আমার ও এই কোম্পানির উপকার হবে ততদিন থাকব।
সিইও : ঢাকার বাইরে কাজ করবেন? আপনাকে ঢাকার বাইরে দিব। শাকিল : জী না, স্যার। বাবা-মার দেখাশোনার জন্য একজনকে থাকতে হবে ঢাকায় তাদের সঙ্গে। সিইও : আপনাদের সবার এই এক সমস্যা। ঢাকার বাইরে যেতে চান না, তাইলে বাকি দেশ চলবে কিভাবে? নিজের সম্পর্কে দুইটা বাজে দিক বলেন তো? শাকিল : একটা খারাপ দিক হচ্ছে, আমি কাউকে তেল দিয়ে কথা বলতে পারি না, উচিত কথাটাই বলতে পছন্দ করি। আরেকটা হচ্ছে...। (শাকিল সাহেব দুইটি দিক মনে করতে পারছিলেন না, সিইও স্যার ইতিমধ্যে শাকিল সাহেবকে পছন্দ করেছেন, তাই তিনি শাকিল সাহেবকে সাহায্য করলেন) সিইও : আরেকটা হচ্ছে, আপনি ঢাকার বাইরে যেতে চান না। আপনি নিজেকে ১০ বছর পর কোথায় দেখতে চান? শাকিল : আমি ১০ বছর পর নিজেকে সিইও হিসেবে দেখতে চাই।
সিইও : সিইও? আপনি সিইও হলে আমি কি করব? (হাসতে হাসতে) শাকিল : আপনার কাছ থেকে শিখব কিভাবে সিইওদের মতো ভাবতে হয়, চলতে হয়। সিইও : নাহ, এটা মানতে পারলাম না। আপনি কি মনে করেন এরকম কম্পিটিটর ক্যান্ডিডেট আমার নেয়া উচিত? শাকিল : জী স্যার, এখনও তো আমি নতুন। মাত্র ৪-৫ বছর কাজ করেছি। এখনও তো স্যার আপনার কম্পিটিটর হইনি। সিইও : আপনার কোনো কিছুই মেলে না, তার ওপর আবার আপনি আমার কম্পিটিটর। আপনাকে নিয়ে তো মহা ঝামেলা, আচ্ছা, আপনাকে বর্তমান কোম্পানিতে কয়টাকা বেতন দেয়? শাকিল : ***** টাকা। (যা পান তার চেয়ে ২০% বাড়িয়ে বললেন) সিইও : আপনি এখন যে বেতন পাচ্ছেন, আমিও সেই বেতনই দিব, তাহলে কি আপনি আসবেন? শাকিল : স্যার, একটু বাড়িয়ে দিলে সুবিধা হতো। সিইও : বাড়িয়ে দিব মানে, কত চান? শাকিল : এখন যা পাই তার চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি হলে ভালো হয়। সিইও : ৩০ শতাংশ বেশি? এই ৩০ শতাংশের থিওরি কোথায় পেয়েছেন? শাকিল : দৈনিক যুগান্তরের চাকরির খোঁজের একটি আর্টিকেল পড়ে জেনেছিলাম। সিইও : আপনারা এত পড়াশোনা করেন। উফ, আচ্ছা, আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার আর কিছু জানার আছে? শাকিল : কোম্পানির পলিসিগুলো সম্পর্কে যদি একটু ধারণা দিতেন। সিইও : আপনি যদি সিলেক্টেড হন, জয়েনের আগে আপনাকে কোম্পানির সব পলিসি সম্পর্কে জানিয়ে দেয়া হবে। তাহলে ভালো থাকবেন, শাকিল সাহেব, আপনার উজ্জ্বল ক্যারিয়ার কামনা করছি। শাকিল : আপনাকেও ধন্যবাদ স্যার, দোয়া করবেন। (প্রস্থান) শাকিল সাহেবকেই ওই পোস্টের জন্য সিলেক্ট করা হয়। পুরো ইন্টারভিউটি লক্ষ্য করুন, ক্যান্ডিডেট কতটা সাবলীল ছিলেন, সিইও স্যার উনাকে যতবার আটকাতে গিয়েছেন, উনি পজিটিভ উত্তর দিয়ে বেরিয়ে এসেছেন। বেতন চাওয়ার ক্ষেত্রে উনি এখন যা পান তার চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি চেয়েছেন। তার মানে, উনাকে যদি একটু কমাতে বলা হয় উনার হাতেও সেই সুযোগ থাকল। পুরো ইন্টারভিউতে লক্ষ্য করুন, সিইও স্যার কিন্তু শাকিল সাহেবকে মজা করার ছলে মানসিক চাপে রেখেছেন। কোথাও একটু অসাবধান হলেই কিন্তু আর কথা এগুতো না। ক্যান্ডিডেট হিসেবে আপনাদেরও এরকম মানসিক চাপে ফেলা হতে পারে। সিইও স্যার প্রথমে ক্যান্ডিডেটের সিভি দেখে মুগ্ধ হয়েছেন।
সে যে ট্রেনিং করে এটাও তাকে শাকিল সাহেবের প্রতি দুর্বল করেছে। তাই, সিভিকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে, সিভিই আপনাকে ইন্টারভিউ বোর্ড পর্যন্ত নিয়ে যায়। ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে সবাই যে উইন করবেন তা নয়, অনেক জায়গায় অনেক কথা বলে আটকে যেতে পারেন, অনেকে পোশাকের কারণে আটকে যেতে পারেন, অনেকে আচরণগত কারণে আটকে যেতে পারেন। সেই বিষয়গুলো নিয়ে সামনের পর্বগুলোতে আরও লিখব। লেখক : (ট্রেইনার ও প্রফেশনাল সিভি রাইটার), চিফ নলেজ ডিস্ট্রিবিউটর, কর্পোরেট আস্ক। ই-মেইল : niazabeed@gmail.com
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment